স্থলপথে ভারতীয় সুতা আমদানি বন্ধ: লাভে না লোকসানে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ সরকার ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করেছে। এতদিন বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা এবং বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি করা যেত। কিন্তু গত মঙ্গলবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক নির্দেশনার মাধ্যমে এই সুবিধা বাতিল করে।
এই সিদ্ধান্ত এসেছে এমন এক সময়, যখন এক সপ্তাহ আগেই ভারত বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এটি একটি কৌশলগত জবাব।
বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছিলেন যে, ভারত থেকে স্থলপথে আমদানিকৃত সুতার ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম চলছে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কম দামে বেশি কাউন্টের সুতা আনা হচ্ছে, যা দেশের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সীমিত পরিদর্শন সামর্থ্যের কারণে ধরা পড়ছে না। যেমন, ৩০ কাউন্ট লেখা থাকলেও চালানের ভেতরে ৮০ কাউন্টের উন্নতমানের সুতা আনার অভিযোগ রয়েছে।
স্থলবন্দরে সুতার সূক্ষ্মতা (কাউন্ট) পরিমাপের যন্ত্র না থাকায় এসব অনিয়ম আরও সহজ হয়েছে। যদিও কয়েক বছর আগে বেনাপোলে একটি মেশিন বসানো হয়েছিল, সেটিও কয়েক মাসের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে অনেক আমদানিকারক প্রকৃত তথ্য গোপন করে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছিলেন।
শিল্প উদ্যোক্তাদের দাবি, ভারতীয় সুতার দাম বাংলাদেশের তুলনায় ৩ থেকে ৫ শতাংশ কম হওয়ায় তা স্থানীয় বাজারে প্রভাব ফেলছিল। আমদানিকৃত সুতা সহজে বেনাপোল সীমান্তে মজুত করা যেত এবং অর্ডার পেলেই ১–২ দিনের মধ্যে তা পৌঁছে দেওয়া হতো। এতে স্থানীয় উৎপাদকরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছিলেন না।
অন্যদিকে, সমুদ্রপথে সুতা আমদানির ক্ষেত্রে এসব অনিয়মের সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম। কারণ, সব চালান চট্টগ্রাম বন্দরে এসে এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয় এবং শুল্ক কর্তৃপক্ষের নজরদারি সহজ হয়। যদিও সমুদ্রপথে আসতে ৩–৪ দিন বেশি সময় লাগে, তবে পরিবহন খরচ প্রায় ১০ শতাংশ কম পড়ে।
ভারতের কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও গুজরাট অঞ্চল থেকে সুতাগুলো আসত। স্থলপথে আনার ক্ষেত্রে সময় লাগত ১০–১২ দিন, আর সমুদ্রপথে চেন্নাই বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত পণ্য আসতে সময় লাগে প্রায় ১৪ দিন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম জানান, রপ্তানিমুখী নিট পোশাক শিল্প অতিরিক্ত পরিমাণে সুতা আমদানি করছিল, যা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। স্থলপথে সহজলভ্যতা থাকায় এ সুযোগের অপব্যবহার হচ্ছিল। তিনি আশা করছেন, স্থলপথ বন্ধ হওয়ায় এসব অনিয়ম বন্ধ হবে এবং স্থানীয় শিল্প লাভবান হবে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রায় ১২ লাখ টন সুতা আমদানি হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৩১.৪৫ শতাংশ বেশি। এটি গত সাত বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ আমদানি।
দেশের ৫১৯টি স্পিনিং মিলের মধ্যে বেশিরভাগ নিট কাপড়ের জন্য প্রয়োজনীয় সুতা এবং অর্ধেকের বেশি ওভেন কাপড়ের সুতা উৎপাদন করে। তবুও ভারতীয় সুতার প্রতি আগ্রহ বাড়ছিল, মূলত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে। গত দুই বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত, যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের নগদ সহায়তা হ্রাস পাওয়ায় স্থানীয় সূতা ব্যবহার নিরুৎসাহিত হয়েছে।
সব মিলিয়ে, স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের এই সিদ্ধান্ত স্থানীয় শিল্প রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।