দিনাজপুরের গ্রামে ব্যতিক্রমী এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গল্প
'ঢং ঢং ঢং'—ঘণ্টার শব্দে ভেসে এল শ্রেণিকক্ষ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে মাঠের সবুজ ঘাসে ছুটে গেল ছোট্ট ছোট্ট পা। কারও হাতে ভলিবল, কেউ মেতে উঠেছে ‘ইচিংবিচিং’ খেলায়। দোলনায় দুলছে কেউ, আবার কেউ উঠছে কাঠের তৈরি স্লিপারে। পাশে রয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা, খেলার সঙ্গী হয়ে। দেখতে দেখতে ছোট্ট খেলার মাঠটি যেন হয়ে উঠল জীবন্ত এক ক্লাসরুম।
এমন দৃশ্য চোখে পড়বে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার কুশলপুর গ্রামে অবস্থিত সুব্রত খাজাঞ্চী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই স্কুলে শুধু ক্লাস নয়, খেলাধুলা, গল্প আর সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়েই শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। ঠিক যেন এক অন্য রকম শিক্ষা পরিবেশ।
জমিদানের গল্প থেকে শ্রেষ্ঠত্বের পথে
২০১১-১২ অর্থবছরে 'বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন' প্রকল্পের আওতায় এই বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। কুশলপুর গ্রামেরই দুই প্রবাসী—বিরাজ খাজাঞ্চী ও সুনীল কুমার সরকার—জমি দান করেন স্কুলের জন্য। প্রয়াত শিক্ষক সুব্রত খাজাঞ্চীর নামে নামকরণ করা হয় বিদ্যালয়টির। একতলা ভবন দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও আজ এটি এক প্রাণবন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
শিশুদের জন্য শিশুর মতো করে শিক্ষা
স্কুলটির প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র রায় ও তাঁর সহকর্মীরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলপ্রেম তৈরি করতে অভিনব সব উদ্যোগ নিয়েছেন। পাঠদানে ব্যবহার হয় মাল্টিমিডিয়া, ছবি, গল্প আর বাস্তব উপকরণ। শিশুদের শেখানো হয় খেলার ছলে, আনন্দের মাধ্যমে। ক্লাসরুমে রয়েছে ম্যাজিক শ্লেট, পাজল, খেলনা বর্ণমালা, বিজ্ঞান বাক্স—যার মাধ্যমে শিশুরা নিজেরাই আগ্রহ নিয়ে শিখে নেয়।
শুধু পড়ালেখা নয়, আছে গান-কবিতাও
বিদ্যালয়ের টিনশেড হলরুম থেকে ভেসে আসে গান ও কবিতার সুর। প্রতি বৃহস্পতিবার চলে সাংস্কৃতিক আয়োজন—গান, আবৃত্তি, বক্তৃতা আর নাট্যচর্চা। স্থানীয় উদ্যোগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে সংগীত ও চারুকলার আলাদা শিক্ষকও। মাঠে নিয়মিত ফুটবল আর ভলিবল খেলার সুযোগও রয়েছে।
সফলতার গল্প: শিক্ষা ও শৃঙ্খলার জয়
মাত্র ১০ বছরের মধ্যে এই স্কুল অর্জন করেছে অনেক সাফল্য। ২০১৭ সাল থেকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। কেউ কেউ পেয়েছে ট্যালেন্টপুল বৃত্তিও। খেলাধুলাতেও পিছিয়ে নেই—জেলা পর্যায়ে রানার্সআপ হয়েছে ফুটবল টুর্নামেন্টে।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহীনা আক্তার বলেন, “যে ছাত্র স্কুলে আসে না, তার খোঁজ আমরা নিই। অভিভাবকরাও এখন আগ্রহ নিয়ে যুক্ত আছেন।”
পিছিয়ে নেই গ্রামবাসীর সহযোগিতা
বিদ্যালয়ের সফলতার পেছনে রয়েছে স্থানীয় মানুষের আন্তরিক সহায়তা। নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার, লাইব্রেরি কর্নার, ছাদবাগান, সাংস্কৃতিক মঞ্চ, সততা স্টোর এমনকি অভিভাবকদের জন্য বিশ্রামাগারও। নিজস্ব অর্থায়নে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চারজন অতিরিক্ত শিক্ষক। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য পোশাকও সরবরাহ করা হয় বিনামূল্যে।
অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বিরাজ খাজাঞ্চী বলেন, “আমাদের গ্রামের শিশুরা শিক্ষিত হচ্ছে, এটা অনেক বড় আনন্দ। ভবিষ্যতে বৃত্তির আওতায় আনার কাজ শুরু করেছি।”
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিনারা বেগম বলেন, “এই স্কুল শুধু চিরিরবন্দরে নয়, পুরো রংপুর বিভাগেই অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে। আমরা আশা করি, জাতীয় পর্যায়েও স্বীকৃতি পাবে।”