নসরুল হামিদ বিপু: লুটপাট, পালিয়ে যাওয়া এবং ‘বিশ্বস্ত পাহারাদার’দের কাহিনি
নসরুল হামিদ বিপু — ভারতের দিকে পলায়ন করা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মাফিয়া চক্রের অন্যতম প্রধান নেতা। বর্তমানে তার পুরো পরিবার আত্মগোপনে রয়েছে। তার সন্তানরা আগেই পশ্চিমা দেশগুলোতে পাড়ি জমিয়েছে, আর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিপুও এখন ভারতে অবস্থান করছেন।
শেখ হাসিনার সাথে পারিবারিক সম্পর্কের সুবাদে বিপু পান ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’— লুটপাটের অবাধ ছাড়। পিতা হামিদুর রহমানের মাধ্যমে শেখ মুজিবের সাথে রাজনৈতিক সংযোগ থাকায় নিজেকে ‘আওয়ামী পরিবারের সদস্য’ পরিচয়ে তুলে ধরতেন তিনি। হামিদুর রহমান যদিও ‘অধ্যাপক’ উপাধি ব্যবহার করতেন, তবে মূলত জমি দালাল হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কেরানীগঞ্জের জমি দালালি থেকেই গড়ে উঠেছিল হামিদ গ্রুপের ভিত্তি।
ছাত্রজীবনেই কেরানীগঞ্জ ও পুরান ঢাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে বিপু। দখল, চাঁদাবাজি এবং হিন্দু পরিবারের দুর্বল ওয়ারিশদের বাড়ি দখল — কিছুই বাদ যায়নি। পরে এসব সম্পদ ব্যবহার করে গড়ে তোলেন 'হামিদ গ্রুপ' — যার অন্যতম প্রতিষ্ঠান 'প্রিয় প্রাঙ্গণ'। আজকের হামিদ গ্রুপে রয়েছে রিয়েল এস্টেট, কনস্ট্রাকশন, গার্মেন্টস, সিরামিকস, ফুড প্রসেসিং, অ্যাগ্রোসহ নানা খাতের ব্যবসা।
গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার আশীর্বাদে বিস্তৃত হয় বিপুর সাম্রাজ্য। সরকারি প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের বড় অংশ ‘বিনিয়োগ’ দেখানো হয় এসব ব্যবসায়। যদিও সাম্প্রতিক দুদকের অভিযানে তার হাতে থাকা সম্পদের একটি ক্ষুদ্র অংশ — মাত্র ৩৮ কোটি টাকার ব্যাংক হিসাব ও কিছু সম্পত্তি জব্দ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রীয় লুটপাটের প্রকৃত পরিমাণ বিশাল।
বিশেষ করে জ্বালানি খাতে বিপুর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে সরাসরি বিভিন্ন প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন। 'নেত্র নিউজ'সহ একাধিক অনুসন্ধানে উঠে আসে, বেনামি কোম্পানি খুলে নিজের মন্ত্রণালয়ের সাথেই ব্যবসা করতেন তিনি। 'পাওয়ারকো ইন্টারন্যাশনাল' এর মতো কোম্পানির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার চুক্তি নিজের পকেটে পুরে নেন বিপু ও তার ঘনিষ্ঠরা। এলএনজি আমদানি খাতে ব্যয়ের বিশাল একটি অংশও চলে যায় তার হাত ধরে বিদেশে পাচার হয়ে।
ক্যাবের গবেষণা বলছে, হাসিনার শাসনামলে বছরে গড়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লুট হয়েছে জ্বালানি খাতে। এর অর্ধেকেরও বেশি নসরুল হামিদ বিপুর সংশ্লিষ্টতায়। অথচ দেশে রাখা বিপুর সম্পদের পরিমাণ এ বিশাল লুটের অতি সামান্য অংশমাত্র।
তবে শুধু জমা রাখা অর্থ নয়, বিপু পরিকল্পিতভাবে বন বিভাগের জমি দখল করে ‘হামিদ ইকনোমিক জোন’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরিবেশ ধ্বংস করে গড়ে তোলা এই প্রকল্প নিয়েও কোনো প্রতিবাদ হয়নি, বরং সরকারি মহলে নীরব সমর্থন মিলেছে।
বিপুর সম্পদ পাহারায় উপদেষ্টার স্বামী!
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর বিপু আত্মগোপনে গেলেও তার প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রয়েছে। বিশ্বস্ত অফিস কর্মকর্তা ও আত্মীয়-স্বজনের পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের একজন নারী উপদেষ্টার স্বামী বিপুর ব্যবসা ও সম্পত্তির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন বলে অভিযোগ। এই ব্যক্তি হামিদ অ্যাপারেলসের বেতনভুক্ত পরিচালক, যিনি একসময় 'নিখোঁজ নাটক'-এর জন্য আলোচিত হয়েছিলেন।
বর্তমানে তিনি নিজ এলাকায় 'তরুণ সমাজসেবক' হিসেবে প্রকাশ্যে সক্রিয়। সরকারি প্রকল্প পরিদর্শন, উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি এবং ‘দুঃখী মানুষের বন্ধু’ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন— যেখানে স্থানীয় প্রশাসন প্রটোকলও দিচ্ছে তাকে।
এভাবে নসরুল হামিদ বিপুর লুটপাটের সম্পদ পাহারা ও ব্যবস্থাপনায় এখনো সক্রিয় রয়েছে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক, যার পৃষ্ঠপোষকতায় রয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও কিছু অংশ।